অতিথি

মৃত্যুর পরের জীবনানন্দ

ভূমিকাঃ
দুঃখজনক হলেও সত্য যে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের উপর সবচেয়ে তথ্যনির্ভর জীবনীটি বাংলা ভাষায় লেখা নয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার শিক্ষক মার্কিন নাগরিক ক্লিনটন বি. সীলি A Poet Apart নামে জীবনানন্দ দাশের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেন। কিন্তু যতদূর জানি বইটি বাংলাদেশে অথবা পশ্চিমবঙ্গে মোটেও সুলভ নয়। সাতটি অধ্যায়ের এই বইয়ের শেষ অধ্যায়টি বর্তমান বাংলা সাহিত্যে কবি জীবনানন্দের প্রভাব বিষয়ক। জীবনানন্দ ভক্তদের জন্য এ অধ্যায়টির অনুবাদ।।


মূল লেখাঃ A Poet Apart by Clinton B. Seely
ভাষান্তরঃ  নাবিউল আফরোজ

 বাংলা ভাষার একমাত্র কবি যিনি  কবিতায় তিক্ততা, অনিশ্চয়তা, যৌনতা, পথের মানুষের ভাষা, ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি, অকপটতা, কলকাতার ভিক্ষুকদের  দ্বিধাহীনভাবে স্থান দিয়েছেন , রাসবিহারী এভিনিউয়ে ট্রামের চাপায় তিনি এখন নিহত, মৃত।।
- অ্যালেন গিনসবার্গ, সিটি লাইটস জার্নাল (City lights Journal, number 2)

কলকাতার তিনটি বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, বসুমতী পত্রিকা জীবনানন্দের মৃত্যুসংবাদ গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করে। একসপ্তাহ পর আনন্দবাজার পত্রিকা রবিবারের সংখ্যায় (৩১ শে অক্টোবর, ১৯৫৪) অজিতদত্তের লেখা ‘কবি জীবনানন্দ’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ নিবন্ধ  প্রকাশ করে।। সাথে জীবনানন্দের একটি কবিতা, যার প্রথম লাইন এপিটাফ হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায় নির্বিঘ্নে।।

------------------------
কেবলি আরেক পথ খোঁজো তুমি; আমি আজ খুঁজি নাকো আর;
পেয়েছি অপার শূন্যে ধরবার মতো কিছু শেষে
আমারি হৃদয়ে মনে; বাংলার ত্রস্ত নীলিমার
নিচে ছোটো খোড়ো ঘর- বনঝিরি নদী চলে ভেসে

তার পাশে; ঘোলা ফর্সা ঘূর্ণিজল অবিরল চেনা পরিজনের মতন,
কখনো বা হয়ে আসে স্থির;
মাঠ ধান পানবন মাছরাঙাদের আলোড়ন
আলিঙ্গন ক’রে বিছিয়েছে তার নারীর শরীর।

ঘরে কোনো লোক নেই- কয়েকটি গ্রন্থ তবু আছে;
রয়েছে গরম ছবি-চারজন পাঁচজন একান্ত শিল্পীরঃ
ফ্রান্সের ইটালির বাংলার কাঙড়ার; -নিম জাম নাগেশ্বর গাছে
রয়েছে অগণ্য সব পাখিদের নীড়।


তবুও মনকে ঘিরে মহাজাগতিক আলোড়ন
আর এই পৃথিবীর অন্তহীন দ্বিধা দ্বেষ  প্রেম সংগ্রাম
আমাদেরো রক্ত দিয়ে আদি রক্তবীজের নিধন
চেয়েছে মিটিয়ে দেবে ষোলো আনা দাম।

এই শতকের দিন ক্ষয় হয়ে এলো আজ,
নবীন আশার বার্তা নীল নিরালম্ব শূন্যে ভেসে
মানুষ যা চেয়েছিল সেই নারী সেই সূর্য আর সে সমাজ
দেবে- তার আত্মঘাতী রণাঙ্গণ একদিন স্তব্ধ হলে শেষে।
(আজঃ অগ্রন্থিত কবিতা, জীবনানন্দ দাশ।।)
 ---------------------------------------------
সুদূর বোম্বের পত্রিকা টাইমস্‌ অব ইণ্ডিয়াও জীবনানন্দের মৃত্যুসংবাদ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে...

“জীবনানন্দের অকালমৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য এমন একজনকে হারালো যে কবি লোকচক্ষুর অন্তরালে নিভৃতে আধুনিক বাংলা কবিতাকে তার রচনা দিয়ে বিপুল ভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।  ১৮৯৮ সালে জন্ম বরিশালের এক শিক্ষকের ঘরে জন্ম নেয়া কবি তার বাবার মতোই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি কলকাতা কলেজে ইংরেজি পড়াতেন। বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারা থেকে সরে গিয়ে মৌলিক কিন্তু অদ্ভুত রচনাভঙ্গি অনুসরণ, এবং তার নিজস্ব স্টাইলের পক্ষে জোরালো অবস্থানের কারণে তাকে চাকুরি পর্যন্ত খোয়াতে হয়েছিলো।  কবিতায় সমাজসচেতনতার চাইতে অনন্য কল্পনাশক্তি আর নিখুঁত চিত্রকল্পের জন্যই জীবনানন্দ বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সর্বগ্রাসী রবীন্দ্রপ্রভাব এড়িয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ স্বীয় বোধ আর সত্ত্বার প্রতি  আমৃত্যু  নিষ্ঠাবান থেকেছেন”। (১লা নভেম্বর, ১৯৫৪)

কবির প্রয়াণে শোকপ্রকাশ এবং বাংলা সাহিত্যে কবির অবদান সম্পর্কে আলোচনা করতে বেশ কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৩১শে অক্টোবর সকাল আটটায় অশোকানন্দ দাশের ১২৭/৩ রাসবিহারী এভিনিউ এর বাসায় কবির সহকর্মী ও বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করা হয়। সেদিনই বিকেলে স্থানীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সঙ্ঘ ‘চলোর্মি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে’র আয়োজনে আরেকটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ কেন্দ্রের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন জীবনানন্দের সমসাময়িক কবিবন্ধু গোপাল ভৌমিক। সে সভায় কবিতা পাঠ ও আলোচনায় অংশ নেন বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বাণী রায়, নরেশ গুহ, রানা বসু প্রমুখ। কবির মৃত্যুর ঠিক দু’দিন পর 'আমাদের দল' এর উদ্যেগে কবির সম্মানে আরেকটি স্মরণসভার খবর প্রকাশিত হয় ২৮ শে অক্টোবরের আনন্দবাজার পত্রিকায়। ‘পাণ্ডুলিপি’ পত্রিকার সম্পাদক জনৈক প্রতাপ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে উক্ত বৈঠকে  রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল ব্যক্তি জীবনানন্দের উপর আলোকপাত করেন; কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন রামশংকর পাত্র, রামনাথ চট্টোপাধ্যায়, এবং তরুণ কুমার দত্ত। বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা কবিকে উৎসর্গ করে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে । সর্বপ্রথম ‘ঊষা’ (সুধীর সরকার এবং প্রাণ সেন সম্পাদিত) অক্টোবর ১৯৫৪ সংখ্যা, এরপর ‘কবিতা’ পত্রিকা তাদের ডিসেম্বর সংখ্যায় কবি জীবনানন্দ এবং তার কবিতা বিষয়ে বেশ কয়েকটি নিবন্ধ ছাপায়। এ সংখ্যায় জীবনানন্দের আটটি কবিতাও প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে সাতটিই অপ্রকাশিত (কবির নোটবুক থেকে নেয়া)। অরুণ ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘উত্তরসূরী’; স্নেহকর ভট্টাচার্য, সমর চক্রবর্তী, যগীন্দ্র মণ্ডল সম্পাদিত ‘ময়ূখ’ (তখন একেবারে নতুন),  ডিসেম্বর-মে, ১৯৫৪-৫৫ সংখ্যায় পূর্বে বিভিন্ন ত্রিমাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত দু’শটি কবিতার একটি তালিকা প্রকাশ করে।  শুদ্ধসত্য বসু সম্পাদিত আরেকটি পত্রিকা ‘একক’, জীবনানন্দ এবং সদ্য প্রয়াত যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত যুগল স্মরণে একটি সংখ্যা বের করেছিলো, কবি যতীন্দ্রনাথও তখন সদ্যপ্রয়াত। হাওড়া গার্লস কলেজ (মৃত্যুর আগমুহুর্ত পর্যন্ত কবি সেখানেই কর্মরত ছিলেন) তাদের অষ্টম কলেজ বার্ষিকী (১৯৫৪-৫৫) কবি জীবনানন্দ দাশকে উৎসর্গ করে। অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত সে সংখ্যায় শিক্ষক এবং সহকর্মী হিসেবে জীবনানন্দ বিষয়ে বেশ কয়েকটি লেখা স্থান পায়।

জীবদ্দশায় তেমন পরিচিতি না পেলেও মৃত্যুর পর বিপুল সংখ্যক পত্রিকায় জীবনানন্দের কবিতা এবং জীবনানন্দকে নিয়ে লেখা পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছিলো, তার জীবন ও কর্মের উপর নিবন্ধ প্রকাশ  হচ্ছিলো। এমনকি ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকাও তাদের সংবাদ সাহিত্য পাতায় জীবনানন্দের সম্পর্কে ছোট্ট একটি লেখা প্রকাশ করে। আপনাদের মনে আছে হয়তো ‘শনিবারের চিঠি’ হচ্ছে সেই পত্রিকা যা ঊনিশ’শ বিশ এবং তিরিশের দশকে জীবনানন্দের কবিতার শব্দচয়ন এবং রচনাভঙ্গিকে কটাক্ষ করে তীব্রভাষায় আক্রমন করে এসেছে দিনের পর দিন। এ আক্রমনের পুরোধা সজনীকান্ত বিব্রত এবং আত্মসমর্পিত ভঙ্গিতে লিখেন,

‘আমাদের যৌবনে আমরা  জীবনানন্দকে হাস্যস্পদ করার চেষ্টায় ব্রতী ছিলাম। পংক্তির পর পংক্তি তুলে দিয়ে জীবনানন্দের দূর্বোধ্যতাকে অবলম্বন করে আমরা তাকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করার প্রাণপন চেষ্টা করেছি। তিনি মূলত ছিলেন কল্লোল-প্রগতি ঘরানার লেখক। তাই তাকে বিরোধী পক্ষ বিবেচনা করে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আমরা একের পর এক আক্রমন শানিয়ে গেছি। বয়েসের সাথে সাথে আমাদের ধারণা ও মনোভাব অনেক পাল্টেছে; কবিও সকল প্রশংসা ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে দেহত্যাগ করেছেন। পূর্বের বিরোধ ভুলে গিয়ে আজ আমরা স্বীকার করছি রবীন্দ্রোত্তর যুগে জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। তিনি সারাজীবন নিষ্ঠা আর আস্থার সাথে কবিতার স্বরস্বতীর সেবা করে গেছেন। তার প্রকাশভঙ্গি দূর্বোধ্য হতে পারে, কিন্তু তার চেষ্টায় কোনো খাদ ছিলো ছিলো না। যেসব সংবেদনশীল পাঠক তার কবিতার গভীরে যেতে পেরেছে তারা অমোঘ আনন্দ লাভ করেছে, তার রচনার প্রতি অলঙ্ঘনীয় আকর্ষণ অনুভব করেছে, যারা পারে নি তারাই কেবল তার থেকে দূরে সরে গেছে। আমরা দ্বিতীয় দলে ছিলাম। যদিও আমাদের উপহাসে তার কাব্যের এবং অবদানের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয় নি, আমরা তার অবদান কোনভাবেই অস্বীকার করছি না। বরং আমরাই আরো সংবেদনশীলতার আহবান জানাচ্ছি এবং তার কবিতাকে বুঝবার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হবার সাধনায় সম্মিলিত হচ্ছি’। (শনিবারের চিঠি, কার্তিক-১৯৬১)

সজনীকান্ত জীবনানন্দের কবিতার আলোচনায় আপাতদৃষ্টিতে নিজেকে অযোগ্য মনে করে আনন্দবাজার পত্রিকায় অজিত দত্তের নিবন্ধের উদ্ধৃতিতে শনিবারের চিঠির অর্ধেকটা উৎসর্গ করেছিলেন।

জীবনানন্দের মৃত্যুর পরের বছর ‘জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নবগঠিত সাহিত্য আকাদেমী থেকে প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষা পুরস্কার পায়। এ আকাদেমীর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভারতের তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি এস. রাধাকৃষ্ণন বলেন, ‘এ আকাদেমির কাজ হবে ভারতের কৃতি মানুষকে সম্মান জানানো, সম্ভাবনাময় মানুষকে সম্মান জানানো, মানুষের সাংস্কৃতিক রুচিবোধ এবং সর্বোপরি সাহিত্যে এবং সাহিত্য সমালোচনার মানকে উন্নত করা’। ভারতের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত বইকে সম্মান  জানাতে এ পুরস্কারের মূল্যমান ছিলো পাঁচ হাজার ভারতীয় রুপী। ১৯৫৫ সালে প্রথমবারের মতো এ পুরস্কার দেয়া হয়,  ভারতের স্বাধীনতার (১৯৪৭) পর থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্তভারতের বিভিন্ন ভাষায়  প্রকাশিত অগণিত বইয়ের মধ্যে পুরস্কার পায় কবি জীবনানন্দ দাশের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’।

এ সম্মাননা জীবনানন্দকে একটা বড় ধরণের পরিচিতি এনে দেয়, এমনকি  নিখিল বাংলা রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মিলন পুরস্কার (বনলতা সেন এর জন্য পেয়েছিলেন) থেকেও বেশি পরিচিত করে জনসাধারণের সাথে। এবং বলাবাহুল্য পূর্বের মতোই জীবনানন্দের কবিতার এই স্বীকৃতি মার্ক্সিস্ট সমালোচকরা খুব স্বাভাবিক ভাবে নেন নি। বনলতা সেনের সমালোচনায় সুভাস মুখোপাধ্যায় যা করেন নি, ‘পরিচয়’ পত্রিকার এক নিবন্ধে মনীন্দ্র রায় তা করেন; তা হলো, জীবনানন্দের সমস্ত কাব্যসৃষ্টির বিচার। স্বয়ং জীবনানন্দকে উদ্ধৃত করে তিনি দেখান জীবনানন্দ সম্পর্কে মানুষের প্রতিক্রিয়া কত মিশ্র এবং কেন?

“আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে, কেউ বলেছেন, এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতি বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ চেতনার, অন্য মনে নিশ্চেতনার কারো মীমাংসায় এ কাব্য একান-ই প্রতীকী, সম্পূর্ণ অবচেতনার, সুররিয়ালিস্ট। আরো নানারকম আখ্যা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্য – কোনো কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।  কিন্তু কবিতা-সৃষ্টি এবং কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিমনের ব্যাপার; কাজেই পাঠক এবং সমালোচকদের উপলব্ধি এবং মীমাংসায় এতো তারতম্য। একটা সীমারেখা আছে এ তারতম্যের; সেটা ছাড়িয়ে গেলে বড়ো সমালোচককে অবহিত হতে হয়।“ (শ্রেষ্ঠ কবিতা কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা, ২০ শে এপ্রিল, ১৯৫৪)

মনীন্দ্র রায় জীবনানন্দ দাশের এ বক্তব্যের কিছু অংশের সাথে একমত প্রকাশ করেন, বলেন যে ব্যক্তিমনের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন সাহিত্যের অন্য যেকোন শাখার চাইতে বেশি পরিলক্ষিত হয় কবিতায়। কিন্তু তিনি যুক্তি দেখান তারপরও  ব্যক্তিমনের সাথে তার ভাষায় সামাজিক মননের একটা মিথস্ক্রিয়া চলতে থাকে। সুক্ষ্ম সমালোচক কাব্যকে বিচার করবেন তৎকালীন সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে।

এই উক্তির আলোকে মনীন্দ্র রায় জীবনানন্দের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থকে সময়ের আঙ্গিকে বিচার করার প্রয়াস পান। প্রতিটি বইয়ের কবিতাগুলোর মূলসুরকে তুলনা করেন সে বইয়ের রচনাকালীন সময়ে সমাজের প্রত্যাশার সাথে। ‘ঝরা পালক’ থেকে ‘মহাপৃথিবী’ এ সব কয়টি কাব্যগ্রন্থকে সাহিত্য বিচারে ব্যর্থ বলে আখ্যা দেন তিনি; কিছুটা সমাজের সাথে প্রাসঙ্গিক মেসেজ না থাকার কারণে, কিছুটা কিছু মৌলিক বিশ্বাসকে কবিতায় ধারণ করতে ব্যর্থতার কারণে, যেমন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা।
মনীন্দ্র রায়ের মতে জীবনানন্দের অন্তত একটি কাব্যগ্রন্থ সমাজ বাস্তবতার বিচারে সফল। সে হলো সাতটি তারার তিমির।
তার ভাষায়, ‘জীবনানন্দ তার চারপাশের বাস্তবতা সম্পর্কে অনেক পরে সচেতন হয়েছেন- ’৪০ এর দশকে- যার প্রেক্ষাপটে ছিলো দূর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, দাঙ্গা, এবং দেশবিভাগ। এসব কবিতার বেশিরভাগই সংকলিত হয়েছে সাতটি তারার তিমিরে। এবং সেকথা বিবেচনায়, জীবনানন্দের এই কাব্যসংকলনটি খুবই প্রশংসার দাবিদার।

৪০ এর দশককেই জীবনানন্দের রচনার উৎকর্ষকাল হিসেবে উপসংহার টেনেছেন মনীন্দ্র রায়। একে সে ব্যাপারটা অতি ক্ষুদ্র, ঘটেছে অনেক বিলম্বে; এবং জীবনানন্দ তার কবিতাকে সমাজ সচেতনতার মাধ্যম হিসেবে তেমন ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারেন নি।

“সাহিত্যিক বিবেচনায় জীবনানন্দের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে ইন্দ্রিয়ের সচেতনতা। প্রথমদিককার কাব্যগ্রন্থে তার এই গুণ তুলনামূলক ভাবে বেশি চোখে পড়ে। চল্লিশের দশকে পারিপার্শ্বিক ঘটনার প্রাবল্য যখন তার দৃষ্টি বাস্তবতার দিকে আকর্ষণ করে তখন তিনি তার কবিতায় তা ধরতে চেষ্টা করেন, যদিও ইন্দ্রিয়প্রখরতার সেই গুণ সামাজিক বাস্তবতার আলোকে কাব্যসৃষ্টিতে কবিকে তেমন সাহায্য করতে পারে নি, আগে যতটা করছিলো।  ক্রমে ক্রমে নিশ্চিতভাবেই কবি তার অনন্য প্রচেষ্টায় তা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি সচেতনভাবে কখনো একটা সামগ্রিক ভাবের প্রকাশের দিকে নিবেদিত হন নি, সে কারণে তার কবিতার একটা বড় অংশ আপাতদৃষ্টিতে বিক্ষিপ্ত বলে মনে হয়, এসব বিক্ষিপ্ত অংশকে একত্রিত করে একটি বৃহৎ উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার”।
“যদি আরো কিছুকাল বাঁচতেন, জীবনানন্দ নিঃসন্দেহে একজন সত্যিকার মহান কবি হয়ে উঠতে পারতেন”।।
(দেবকুমার বসু সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ স্মৃতি’ নামক নিবন্ধে মনীন্দ্র রায়)

যদিও মনীন্দ্র রায়ের বিশ্লেষণ অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক বলে অনুভূত হয়, তথাপি তার উপসংহার তর্কসাপেক্ষ।  আজ মনীন্দ্র রায়ের কথার একেবারে বিপরীতে গিয়ে বলতে হয় জীবনানন্দ সত্যিকারভাবেই একজন বড়ো কবি হিসেবে পরবর্তীকালে পরিচিতি পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড়  কবি।  তার এ পরিচিতির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে নিজের অনুভবের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম স্বাদ ভাষায় প্রকাশ করবার অপরিসীম ক্ষমতা।  ‘মহৎ বা বড় সাহিত্যকর্মকে অবশ্যই সামাজিক দায়বদ্ধতা ধারণ করতে হবে’, মনীন্দ্র রায়ের এই হাইপোথিসিসের সাথে বাংলার পরবর্তী সমালোচকরা কিছুতেই একমত হন নি। কিন্তু ‘সাতটি তারার তিমির’ জীবনানন্দের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের তুলনায় অনুভূতির ভাষিক প্রকাশের দিক দিয়ে ব্যর্থ’, মনীন্দ্র রায়ের এই উপসংহার অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য। এ কারণেই সাতটি তারার তিমিরের কিছু রচনা ঠিক জীবনানন্দীয় হয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ অথবা ‘বনলতা সেন’ নিয়ে মনীন্দ্র রায় এবং সুভাষ  মুখোপাধ্যায়ের ঋনাত্মক মনোভাব একেবারেই অবাঞ্চিত।  এ দু’ কাব্যগ্রন্থে সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সমাজের প্রতি মেসেজে’র ঘাটতি থাকতে পারে কিন্তু কাব্যিকবিচারে  জীবনানন্দের এই সৃষ্টিদ্বয় কালোত্তীর্ণ প্রমাণিত হয়েছে। এদের আবেদন এখনো সজীব।

পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে জীবনানন্দের উপর মার্ক্সিস্ট আক্রমণ স্তিমিত হয়ে আসে। এর পেছনে প্রধানত দু’টি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, জীবনানন্দ তখন জীবিত নন।। যদিও তার কবিতা বিভিন্ন মাসিক, সাপ্তাহিক, ত্রিমাসিক পত্রিকার সাহিত্যপাতায় তখনও প্রকাশিত হচ্ছে, মার্ক্সিস্ট সমালোচকরা প্রয়াত কবির প্রতি সমব্যথী হয়ে হইয়তো অন্যদিকে মন দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, কমিউনিস্ট ভাবধারার লেখকদের বিশ্বাসের জায়গাটা বড় ধরণের ধাক্কা খায় যখন ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন জোসেফ স্ট্যালিনের নির্মমতার কথা বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশ করে। আবু সাইয়ীদ আইয়ূবের মতে বামপন্থী কবিরা এ ঘটনার পর মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন। ‘৫০ এর দশকের সেই বিরূপ সমালোচনার পর জীবনানন্দের প্রতি সমালোচকদের মুগ্ধতা বেড়েই চলেছে। যদিও কিছু সমালোচক চল্লিশের দশক এবং পঞ্চাশের দশকে রচিত কিছু লাইনের বিচ্ছিন্ন প্রশংসা বিভিন্ন রচনায় করেছেন, জীবনানন্দ সমালোচকদের মনোযোগ এবং মুগ্ধতা মূলত বিশের দশক এবং তিরিশের দশকে রচিত  ‘বোধ’, ‘বনলতা সেন’, ‘আট বছর আগের একদিন’ এর মতো কবিতাতেই সীমাবদ্ধ।।


আজ জীবনানন্দ স্রেফ একজন গুরুত্বপূর্ণ কবিই নন, বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী কবিদের একজন।  অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এর মতে এ বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে রবীন্দ্রনাথ যেমনটা ছিলেন, জীবনানন্দ বর্তমানে ঠিক ততটাই বিপদজনকভাবে প্রভাবশালী।  সেসময়কার কবিরা যেমন নিজের অজান্তেই রবীন্দ্রবলয়ে আটকা পড়ে যেতেন, তেমনই এ সময়ের কবিদের সর্বদা সতর্ক থাকা উচিত যাতে তারা স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে জীবনানন্দের  স্টাইলের অনুকরণে মত্ত না হয়ে যান, জীবনানন্দের প্রভাব এতটাই অনিবার্য।   জীবনানন্দের মৃত্যুর ঠিক পরপর ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে অনুষ্ঠিত কবি সম্মেলন যেখানে প্রায় ষাটজন তরুণ কবি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন তার  প্রসঙ্গে বাণী রায় লিখেছিলেন,“জীবনানন্দের জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রয়ে গেছে সেদিন পঠিত কবিতাতেই। আজকের তরুণ কবিদের প্রায় আশি ভাগ তাদের কবিতা জীবনানন্দের মতো করে লেখার চেষ্টা করছে”। প্রাণবন্ধু দাশগুপ্ত এ কথা চল্লিশেই বুঝেছিলেন, ‘’বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু (বিশেষ করে জীবনানন্দ) এরাই হচ্ছেন বর্তমান কবিদের মূল অনুপ্রেরণা’’


শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় জীবনানন্দের প্রভাব সম্পর্কে যেন আরো একটু বেশি মুখর, “আমার মতে বর্তমানে বাংলায় এমন কোনো কবি নেই যিনি তার কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এদের অনেকেই তা স্বীকার করবেন না, কারণ ‘প্রভাব’ এমন একটি বিষয় যা মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বাকে খাটো করে।  আমাদের, যাদের আত্মসম্মানবোধ প্রবল তারা কখনোই অন্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হতে চাই না। কিছুদিন আগে একটা অনানুষ্ঠানিক সমাবেশে ঠিক এ প্রসঙ্গটাই উত্থাপন করে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েছিলাম। মনে হয় ‘প্রভাবিত’ এর চেয়ে ‘আলোকিত’ শব্দটি বেশি সঠিক; কারণ জীবনানন্দের প্রভাব চাঁদের আলোর মতো ম্লান, হলুদ। তার শব্দাবলীই আমাদের অনুভবের অভিধান, আমাদের বিষণ্ণতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, আক্রান্তময়তার আশ্রয়। এক কথায় জীবনানন্দ ছিলেন এ দশকের অমোঘ নিয়তি”।। (জীবনানন্দের প্রভাব, দৈনিক কবিতা, ২০শে জ্যেষ্ঠ ১৩৭৩).




যদিও জীবনানন্দের প্রভাবের বেশিরভাগই শুধুমাত্র ‘আলোকিত’ করে যাওয়া; তবু কিছু কিছু রচনায় তা সূর্যের  মতোই উজ্জ্বল।  যেমনটা কৃষ্ণ ধরের হাইকু ধর্মী এসব কবিতায়,

 ১।
জোছনা রাত
ঝর্ণা
ঘাইহরিণ

২।
গহীন বন
বাঘের চোখ
নিবিড়

কৃষ্ণ ধর ব্যবহার করেছেন, ‘ঘাইহরিণ’ আর জীবনানন্দ লিখেছিলেন ‘ঘাইহরিণী’- তবু প্রথম হাইকুতে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘ক্যাম্পে’র প্রভাব স্পষ্ট। ‘কলকাতা এবং আমার নির্জন বিছানা’  কবিতায় শমসের আনওয়ার স্পষ্টই ‘বনলতা সেন’ এবং ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কাব্যগ্রন্থে অঞ্জলি দিয়েছেন। বিশেষত তিনি যখন বলেন, ‘আমার স্বপ্নে কোন বিদর্ভ জেগে ওঠে না’। ‘আমি অনবগত বিষাদহীন অশোক’ অথবা ‘টায়ার সমুদের পারে কোন এক প্রাসাদ সম্বন্ধে/ আমার শিথানের পাশে কোন বনলতা সেন রাত জাগে না’।। অন্তর্মুখী জীবনানন্দের মতই উচ্চারণ করেন, ‘সস্তা সুগন্ধী তৈলচিক্কণ চুলে/  বিদিশার অন্ধকারের খোঁজ করতে গেলেই আমার হাসিতে উদ্বেগ ভর করে'।


বাংলা কবিতায় ষাটের দশকে একঝাঁক তরুণ কবি প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে আক্রমণ নিজেদের ‘হাংরি জেনারেশন’ বলে  ঘোষণা করেন, এবং  জীবনানন্দকে তাদের নিজস্ব ভাবধারার পূর্বসূরী বলে দাবি করেন। হাংরি আন্দোলনের পথিকৃৎ মলয় রায় চৌধুরী তাঁর কবিতায় জীবনানন্দের কথা সরাসরি উল্লেখ করেছেন,
  
--------------------------------------------------------------------------
শিল্পের স্বাধীনতা যে চায় সে মূর্খ
আমি শিল্পীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে
শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের কেনা চাকররাই স্বাধীন কেননা তারা শিল্পী নয়, তারা মিথ্যাবাদী চুরিবিশারদ আর মরা রোবোট
উন্মাদ সংস্কৃতিগুলোই কেবল শিল্পীকে চায়
শিল্প হল ভবিষ্যবাণী কেননা সর্বনাশের আগে দরকার অমঙ্গলের পূর্বাভাস
বিবেকী সভ্যতার জন্যে চাই লোকসংস্কৃতি যা আসলে প্রকৃতি, তা মোটেই শিল্প নয়
কোনো বিবেকী সরকারের আবির্ভাব এখনও হয়নি
কোনো শিল্পীর পক্ষে সমঝোতা করা সম্ভব নয় কেননা সে আসলে তিনি
শিল্প হল আঘাতের উপশম
আমি মানবতার আঘাতপ্রাপ্তি চাই না কেননা আমি সর্বনাশের বিরুদ্ধে
শিল্পীকে একা যুঝতে হবে কেননা সে-ই তো উপশম আনে
শিল্পীকে নিজের পথ নিজে তৈরি করতে হবে
স্বাধীনতার জন্যে সে ভিক্ষা চাইবে না বা দরদস্তুর করবে না
বাইরে থেকে স্বাধীনতা পাবার জন্যে সে দুর্বলের কান্না কাঁদবে না
মিশর বয়ে চলে গেছে নীল নদের জলে
'লোহার দেয়াল' ভেঙেছেন ভ্যান গঘ যা তিনি একটি চিঠিতে বলেছিলেন
কলকাতাও মিশে যাবে ধুলায়
কিন্তু জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকবেন চিরকাল আমার আর তোমার ভেতর
আমি শিল্পের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে
অসুস্হ নৃশংস ব্যবস্হায় শিল্পীর অস্তিত্ব অসম্ভব
মানবতার বেদীতে শিল্প হল আত্মাহুতি
তাই আমি বলি শিল্পীর জন্যে চাই জিঞ্জির
তাকে ঘিরে উঠুক পাতালের নীলাভ বিষবাষ্প
তাকে বসাও বিদ্যুৎবাহী চেয়ারে
তার জন্যে চাই ফাঁসিকাঠ
জীবন্ত পোড়াও তাকে
তাকে পাঠাও অন্ধকার স্যাঁতসেতে ঘেমো জেলখানায়
তার জন্যে পাগলাগারদ
কেননা ফ্রাংকো আর সালাজারের কবর হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের গোরস্হান
অবিনশ্বরতায় পাস্তেরনাকের পাশে ঘুমাবেন লোরকা আর আমিও থাকব সেখানে
আমি কারোর কাছে স্বাধীনতার গারেন্টি চাই না
আমার যেমন ইচ্ছে হবে তেমন লিখব
যেখানেই থাকি না কেন যা ভাল লাগবে তা-ই লিখব
চন্দ্রালোকের মহাপ্লাবনে ওঠা আমার রক্তের জোয়ারধ্বনি আমি শুনতে পাই
আমি কারোর কাছে আমার স্বাধীনতা দাবি করি না
অজস্র সরকার উড়ে যাবে কবিতার ফুঁয়ে
শিল্পীর সামনে তাবৎ উন্মাদ সভ্যতা হাঁটু গেড়ে গোঙাবে
সময় যার আরেক নাম কবিতা তার সুষমাকে কোনো আণবিক বিস্ফোরণ দমাতে পারবে না
 (শিল্পের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে: মলয় রায়চৌধুরী)

 -------------------------------------------------------------------------------

জীবনানন্দের এ অবদানকে তারা উদযাপনও করেছেন সুযোগ পেলেই। কলকাতার খালাসী তলা’র খালাসীদের বারে বসে হাংরি জেনারেশনের কবিরা জীবনানন্দের জন্মোৎসব উদযাপন করেন (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮)। পাটনায় বাস করার কারণে মলয় রায় চৌধুরী হয়তো এ উৎসবে সামিল হতে পারেন নি। স্টেটস্‌ম্যান পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর বেরোয়,


''গত সোমবার (১৯শে ফেব্রুয়ারি) কলকাতার তরুণ কবিদের, যারা নিজেদের বিদ্রোহী বলে দাবি করেন তাদের জন্য ছিলো একটা বিশেষ দিন। সেদিন ছিলো তাদের গুরু এবং অনুপ্রেরণার উৎস জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন, যদিও জীবনানন্দের জীবদ্দশায় তারা বোধহয় কেউই তাঁর সংস্পর্শে আসেন নি।  সাধারণত এরকম উৎসব যেভাবে উদযাপিত হয়, তার থেকে এ অনুষ্ঠান ছিলো স্পষ্টই আলাদা, এর আয়োজকদের পরিকল্পনাও তেমনটাই ছিলো।  শহরের কোনো সাংস্কৃতিক সদন এর পরিবর্তে এ উদযাপন অনুষ্ঠিত হয় সেন্ট্রাল কলকাতার একটি দেশি মদের দোকানে। অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত অতিথি বলতে কেউ ছিলো না। অশরীরী কিন্তু সর্বব্যাপী জীবনানন্দীয় স্পিরিট ছিলো সে সন্ধ্যার প্রধান অতিথি।।

হাংরি জি’স এর কবিরা এককোণে নড়বড়ে একটা টেবিল দখল করে সেলিব্রেশন শুরু করলেন। উদযাপন শুরু হলো সকলের এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে। শালেশ্বর ঘোষ, যিনি এ প্রজন্মের কাছে উদীয়মান কবি হিসেবে সম্মানিত তিনি প্রথমেই ব্যাখ্যা করলেন, ‘জীবনানন্দের জন্মবার্ষিকীর উদযাপন কেন এখানে হচ্ছে?  কারণ জীবনানন্দ এ জায়গা দ্বারা সর্বক্ষণ অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সুতরাং আমরা শুধু প্রথার অনুসারী।  চশমা অলঙ্কৃত শীর্ণদেহী কবি তারপর স্বরচিত ‘জন্মনিয়ন্ত্রন’ কবিতাটি পড়তে শুরু করলেন। অতিসম্প্রতি লেখা সে কবিতার বিষয়সম্ভার অতি বিচিত্র; জন্মপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে রন্ধনশিল্প পর্যন্ত সবই তার অন্তর্গত। তবে শ্রোতারা বড়ই অমনোযোগী, কবির কণ্ঠ অবিরাম হইচই এর মধ্যে ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠছিলো।

এরপর আরেকজন ‘হাংরি জি’স  তাদের এ আন্দোলনের প্রতিকূলতার কথা বর্ণনা করে উষ্মা এবং দুঃখপ্রকাশ করলেন। ‘আমাদের দল ভেঙে যাচ্ছে, আমাদের লেখা কেউ ছাপাতে চায় না,  আমাদের সহযোদ্ধাদের স্পেশাল ব্রাঞ্চের গোয়েন্দারা অজানা কারণে সর্বত্র অনুসরণ করে চলেছেন’। এরপর তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন, ‘যারা ভাবে আমরা লিখতে জানি না, তাদের ধিক্কার জানাই। আমরা স্বাধীন। আমাদের চিত্ত যে কোন বিষয়ে ভাবতে পারে, আমাদের কলম যেকোনো কিছু লিখতে পারে’।  ‘একদিন আমাদের সৃষ্টি সমস্ত বাঙালী জাতির কাছে সমাদৃত হবে’ এই বলে তিনি তার বক্তৃতার ইতি টানলেন। স্বাভাবিকভাবেই অসংখ্য বোতল এবং পেয়ালা চৌচির ভাঙার উৎসবের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হলো''। (২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৮)

জীবনানন্দ নিশ্চিতভাবেই কখনো খালাসী তলায় যান নি; সেখানে রাত জেগে পান করা দূরে থাক। সে’রাতে এই কবিদের একেকজন যা পান করেছিলেন, জীবনানন্দ সারাজীবনে সে পরিমাণ পান করেছেন কি না সন্দেহ। কিন্তু তিনি সর্বস্তরের এবং সববয়েসী কবিদের নানানভাবে কতটা প্রভাবিত করেছিলেন উপরের ঘটনা থেকে  তা পরিষ্কার ।

মলয় রায় চৌধুরী’র হাংরি কবিতা থেকে আরেকটু  মৃদু সুরের কবিতা আব্দুল মান্নান সৈয়দের ‘জীবনানন্দ’। ‘জীবনানন্দ’ কবিতায় আব্দুল মান্নান সৈয়দ আজকের অনেক কবি যা প্রতিনিয়ত অনুভব করেন তাই মেটাফোরিক্যালি ফুটিয়ে তুলেছেন - অর্থাৎ জীবনানন্দ আজো বাংলায় মিশে আছেন, অনন্তকাল মিশে থাকবেন, এই মহাসত্য এ কবিতার মূল বক্তব্য।।

 ----------------------------------------------------------
জীবনানন্দকে মাঝে-মাঝে দেখি রাস্তায়।
বলিষ্ঠ শরীর, আধ-ময়লা পাঞ্জাবি, আধময়লা ধুতি
হাঁটুর নিচ অব্দি লেগে রয়েছে, পায়ে অস্পষ্ট স্যান্ডেল
কি মোকাসিন,
শুধু দু'চোখে তাঁর
আমার ছেলেবেলার হারিয়ে-ফেলা সবুজ প্রিজম
দু'টুকরো হ'য়ে জ্বলছে।


গ্রীন রোডের মাথায় দেখেছি একদিন,
একদিন স্টেডিয়ামের দোতলায় বইএর দোকানে
ওঠার সময় সিঁড়িতে আমার পাশ দিয়ে দ্রুত নেমে গেলেন,
একদিন দেখি লেকের ধারে হেঁটে চলেছেন গভীর আত্মনিমগ্ন,
আর-একদিন মাছের গোল বাজারে চক্কর খেতে-খেতে।

উৎসুক হ'য়ে তাঁকে দেখতে-না-দেখতে
ভিড়ের ভিতরে মিশে যান তিনি,
জনশূন্যতার ভিতরে মিশে যান।

শুধু একদিন পাশ দিয়ে যাবার সময়
আমার দিকে এক-পলক উদাসীন তাকিয়ে
যেন স্বগতোক্তির মতো উচ্চারণে
'এতোদিন কোথায় ছিলেন?'
ব'লে, কোনো জবাবের জন্যে দেরি না-ক'রে
নির্মোহতার ভিতরে মিশে যান।
একদিন সন্ধেবেলা দেখি তাঁকে
ধরা-পড়া নক্ষত্রের মতো লজ্জিত
দাঁড়িয়ে আছেন ঢাকার সবচেয়ে নির্জন মাঠের উপরে-
আমি মাঠের পাশ দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলাম-
দেখি তাঁর চুলে রাত্রি থেমে আছে,
চোখের সবুজ প্রিজমের ভিতর থেকে লাফিয়ে পড়ছে ফড়িং


হেমন্তের শিশিরের সুঁই ঘিরে ধরছে তাঁর পদযুগল
কোন আদিম দেবতার কাছে নতজানু
ধূসর মানুষের মতো
দেখি তাঁর ধুতি-পাঞ্জাবি কুয়াশার সুতোয় বোনা,
দেখি তাঁর বিড়বিড় স্বগত-উচ্চারণ থেকে
বেরিয়ে আসছে সন্ধেবেলার সবগুলো তারা
দেখি তাঁর পাঞ্জাবির ঢোলা পকেটে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ।


তারপরই জীবনানন্দ হাঁটতে শুরু করলেন
উদ্দেশ্যহীনের মতো কোনো-একদিকে
আমার জীবনবেদনা থেকে দূরে-দূরতরে
(জীবনানন্দ : আব্দুল মান্নান সৈয়দ)
 ---------------------------------------------------

জীবনানন্দের কবিতার সাথে সম্বন্ধযুক্ত নামের অনেকগুলো ম্যাগাজিন পরবর্তীকালে আত্মপ্রকাশ করে।  ‘ধানসিড়ি’ (জীবনানন্দের বিভিন্ন কবিতায় ব্যবহৃত নদীর নাম), ‘বিভিন্ন কোরাস’, ‘সিন্ধুসারস’,  এমনকি জীবনানন্দের কাব্যগ্রন্থের নামে  ‘বেলা অবেলা কালবেলা’  এরকম নানান পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গে অহরহ চোখে পড়ে। ‘জীবনানন্দ প্রাসঙ্গিকী’ নামে একটি বইয়ে লেখক সন্দ্বীপ দত্ত জীবনানন্দের কবিতার শব্দ ব্যবহার করে বের হওয়া ত্রিশটি লিটল ম্যাগাজিনের একটি তালিকা প্রকাশ করেন, এদের মধ্যে একটি ম্যাগজিনের নাম ছিলো একেবারে সরাসরি, ‘জীবনানন্দ’। চটি আকারের এই প্রকাশনায় সম্পাদক ব্যাখ্যা করেন কেন  ‘জীবন আনন্দের অপর নাম কবিতা’।

বাংলাদেশ হতে জীবনানন্দের কবিতা, জীবনানন্দকে উৎসর্গীকৃত কবিতা, এবং জীবনানন্দের কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে সর্বপ্রথম প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘পরম্পরা’; বের হয় ডিসেম্বর, ১৯৮০ সালে। সে পত্রিকার অনেক লেখকই সে সংখ্যায় সংকলিত তাদের নিজস্ব কবিতায় জীবনানন্দের শব্দাবলী, তাঁর কবিতার চরিত্র, উপমা, আর চিত্রকল্প সচেতনভাবে ব্যবহার করেন। এরপর পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের হয় ‘জীবনানন্দ আকাদেমি পত্রিকা’; জীবনানন্দের সাহিত্য ও প্রতিভার বিশ্লেষণের নিমিত্তে। ‘সম্পাদক সমীপে’ নামক চিঠিপত্রের বিভাগে জীবনানন্দ স্মরণে কলকাতার একটি রাস্তার নামকরণ করার প্রস্তাব করা হয় সে পত্রিকায়।


 আমরা দক্ষিণ কলকাতার সাউদার্ণ এভিনিউকে জীবনানন্দ এভিনিউ নাম করার প্রস্তাব করছি। আজ পর্যন্ত কলকাতা শহরে প্রতিভাবান এবং প্রভাবশালী এ কবির কোনো স্মারক আমরা স্থাপন করতে পারি নি।  ... এবং দক্ষিণ কলকাতা এবং সংলগ্ন রবীন্দ্র লেক এর সাথে কবি জীবনানন্দ এর যোগসূত্রও খুব পরিষ্কার’।।

বিশ শতকের শেষভাগে এসে প্রায় প্রত্যেক বাঙালী সমালোচকই  কবি  জীবনানন্দকে রবীন্দ্রনাথের পর সবচেয়ে শক্তিমান কবি হিসেবে কোন ভাবে না কোনভাবে উল্লেখ করেছেন। বাণী রায় জীবনানন্দকে বলেছেন, ‘আধুনিক বাংলা কবিতার জনক’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার আবির্ভাবকাল বলা হয়  দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়টুকুকে।

কবি টি এস ইলিয়ট গদ্য কবিতা সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ জানিয়েছেন এভাবে,‘কবিতাকে সংলাপ ধারণ করতেই হবে এই বাধাধরা নিয়মে আমরা সবসময় নির্ভর করতে পারি না। কবিতায় প্রতিটি বিপ্লবই সমানভাবে গ্রহণযোগ্য, অনেকক্ষেত্রে কাম্য, গদ্য কবিতা কবিতার ভাষাকে কথ্য ভাষার অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছে, আনবে। ফলশ্রুতিতে কথ্য ভাষায় কবিতার অনেক উপাদান ঢুকে যাবে, সমৃদ্ধ হতে হতে একসময় কথ্য ভাষাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে কবিতার কাব্যধর্ম বজায় রাখতে তখন আরেকটা বিপ্লব প্রয়োজনীয় এবং অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে’।


বাংলা কবিতার আধুনিকতা বুঝতে আমাদের মুখ ফেরাতে হবে গদ্য কবিদের দিকেই। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কবিতার সকল ফর্মের মধ্যে এটাই সবচেয়ে কম অনুবাদযোগ্য।  বুদ্ধদেব বসু একসময় ‘জীবনানন্দ তার কবিতার জন্য নিজস্ব শব্দভাণ্ডার তৈরি করে নিয়েছেন’ বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি জীবনানন্দের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে লিখেন,

‘এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দের আগে কোন বাঙালি কবিই কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ এবং ইংরেজি শব্দের এত বিস্তৃত, স্বচ্ছন্দ এবং যৌক্তিক ব্যবহার করেন নি। এ সব উদাহরণ (জীবনানন্দের কবিতা থেকে) নিজেদের রচনা সম্পর্কে আমাদের আরো সাহসী হতে অনুপ্রাণিত করে’। (কবিতা পত্রিকা, পৌষ-১৩৬১ বঙ্গাব্দ)

বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্যের সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় দিকটি হলো তিনি কিন্তু জীবনানন্দের কবিতাকে কথ্য ভাষা বা গদ্য কবিতা বলে  একেবারেই অভিহিত করেন নি। যদিও এ ব্যাপারে দীপ্তি ত্রিপাঠী’র মতামত ভিন্নঃ
‘এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আধুনিক কবিদের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো মুখের ভাষা এবং কবিতার ভাষার মধ্যে ব্যবধানটুকু কমিয়ে আনা।  স্বভাবতই তারা সবাই কবিতাকে প্রত্যক্ষভাবে  কথ্য ভাষায় ব্যবহৃত উপমা, ধ্বনি, শব্দের মাঝে নিয়ে আসতে চেয়েছেন, এমনকি একেবারেই স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষাকেও কবিতায় স্থান দেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের কেউই জীবনানন্দের মতো এতো সহজ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে তা করে দেখাতে সক্ষম হন নি’। (আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয়, দীপ্তি ত্রিপাঠী)

যদিও দীপ্তি ত্রিপাঠীর উচ্চারণ মোটাদাগে অনেকটাই বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্যের প্রতিধ্বনি, দীপ্তি ত্রিপাঠী জীবনানন্দকে সাধারণের মুখের ভাষার সাথে বাংলা কবিতার যোগসূত্রস্থাপনকারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে এটা অনস্বীকার্য, জীবনানন্দ তার কবিতায় সম্পূর্ণ নিজস্ব শব্দ ব্যবহার করতেন। অম্বুজ বসুর মতে, ‘জীবনানন্দের কাব্যভাষা নিশ্চিতভাবেই বাংলা কবিতার সাধারণ কাব্যভাষা নয়, এমনকি এটা তার মুখের ভাষাও নয়’। (একটি নক্ষত্র আসে- অম্বুজ বসু)। শরৎ কুমার এর মতে জীবনানন্দ দাশ  ইচ্ছাকৃতভাবে সাধু ভাষার সাথে চলিত ভাষা মিশিয়ে এক ধরণের অস্বস্তি সৃষ্টি করতেন। অনেকটা পরিহাসের ভঙ্গিতে তিনি যোগ করেন, ‘এটা আমাদের মহানুভবতা যে যখন আমরা পড়ি, এ ব্যাপারটা আমরা মেনে নেই, তার বর্ণনাভঙ্গির প্রতি কোন বিরূপভাব আমরা পোষণ করি না। কিন্তু আমাকে বলতেই হয় যে এই মিশ্রণ এখন কবির প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে’। তার ভাষায়, ‘সত্যিই কি সাধু এবং চলিতের মিশ্রণ কোন বাক্যকে খুব শ্রুতিকটু করে তোলে? কিন্তু একমাত্র জীবনানন্দ ছাড়া আমরা আর কারো কাছ থেকে এই মিশ্রণ মেনে নেই নি, এটা তার সাফল্য যে তিনি আমাদের কাছ থেকে তা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। জীবনানন্দ সময়ে সময়ে মাত্রাবিন্যাস মানেন নি, ক্রিয়াপদ ব্যবহারে তিনি প্রায়ই ভুল করেছেন যেমন ছড়াতেছে (এটি সাধুও নয়, চলিতও নয়), তিনি কিছু অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করে যেমন ভাঁড়, গাঁট, হাইড্র্যান্ট, বেফাঁস  পাঠককে   বিপদে ফেলেছেন। পাঠকের বিরক্তি শেষ হতে না হতে তিনি তাকে নিয়ে যান প্রসঙ্গান্তরে’।

সজনীকান্তের মতো কিছু পাঠক কবির শব্দ ব্যবহারের এই খামখেয়ালীপনায় কতটা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন তা আমরা আগেই বলেছি।
রবীন্দ্রনাথ অথবা বাংলা সাহিত্যের অন্য আরো বড় কবির সাথে জীবনানন্দকে এক কাতারে বসানো যায় না কারণ জীবনানন্দ তার নিজের অজান্তেই বাংলা কবিতার ইতিহাসে এমন একটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যাতে কবি তার ইচ্ছেমত শব্দ ব্যবহারের স্বাধীনতা লাভ করেন।  বাংলা   পড়তে না জেনেও অ্যালেন্স গিন্সবার্গ জীবনানন্দের কাব্যরসের সন্ধান পেয়েছিলেন হাংরি’দের সাথে চলতে চলতে,যেমনটা তিনি বলেছেন, ‘তিক্ততা, সন্দেহ, যৌনতা, পথের মানুষের ভাষা, ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি, অকপটতা, কলকাতার ভিক্ষুকদের’ নিয়ে। গিন্সবার্গ এবং ডিলান থমাসকে যেভাবে ইলিয়টের সাথে তুলনায় আনা হয়, তেমনভাবে বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের সম্পূরক স্থানটি জীবনানন্দের।

ভাষার দক্ষ ব্যবহার, তীব্রবোধগ্রস্ত চিত্রকল্প, ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রবল প্রকাশ, বিপুল অনিশ্চয়তা এবং ততোধিক বিপুল অনিরাপত্তার বিশ্লেষণধর্মী অনুসন্ধান- এসব মিলিয়েই জীবনানন্দের সৃষ্টি এবং এসবই জীবনানন্দের কাব্যের শক্তি। জীবনানন্দের সমসাময়িক এবং পরবর্তী যুগের কবিরা যখন  তার কবিতায়  ভাষার নবতর প্রয়োগ এবং আবহমান বাংলার চিরন্তন প্রকৃতির ভাষিক প্রকাশের কথা বলেন তখন তা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বাইরের পৃথিবীতে জীবনানন্দকে ততটা স্পষ্ট করে তুলে ধরে না।  বরং নৈরাশ্যবাদী, নিঃসঙ্গ, এবং প্রকৃতিতে আত্মমগ্ন বিশেষণেই জীবনানন্দকে বেশি ভালোভাবে বুঝতে পারা যায়। কবি নিজে  লিখেছিলেন, ‘কবিতা-সৃষ্টি এবং কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিমনের ব্যাপার’। জীবনানন্দের কাব্য শেষ পর্যন্ত একজন সাধারণ মানুষের সুক্ষ্ম অনুভবের তীব্র প্রকাশ, ভাষিক ব্যবধান তুচ্ছ করে পুরো পৃথিবীকে যার অনেক কিছু বলবার আছে। জনতার কোলাহল থেকে দূরে সরে থাকা এই সাদাসিধে মানুষটি বরাবরই কবি ছিলেন; তিনি  বিচ্ছিন্নতার কবি।।   


কৈফিয়তঃ
১। অনুবাদ করার আগে মূল লেখকের অনুমতি নেয়া হয়েছে।।
২। অনুবাদে মূলের সাথে সঙ্গতি রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে পরম্পরা বোঝাতে আলাদা ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে অতিরিক্ত লাইনের মাধ্যমে।
৩।  এ লেখার সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত। অনুবাদকের অনুমতি ছাড়া অনলাইন বা প্রিন্ট মিডিয়ায় আংশিক বা সম্পূর্ণ কপি-পেস্ট না করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।।

কৃতজ্ঞতাঃ
হাংরি আন্দোলনের পথিকৃৎ মলয় রায় চৌধুরীকে ধন্যবাদ তার কবিতার মূলপাঠটি মেইল করার জন্য।। সচলায়তনের ব্লগার নজরুল ইসলাম ভাইকে ধন্যবাদ আব্দুল মান্নান সৈয়দ এর 'জীবনানন্দ' কবিতার মূলপাঠটি দিয়ে সাহায্য করার জন্য। এ দু'টি কবিতা ছাড়া এ লেখা সম্পূর্ণ হতো না।।

0 comments:

ই বুক